শিক্ষককে হত্যার পর টাকা লুট, সমকামীতার নাটক সাজিয়ে চিরকুট

শিক্ষককে হত্যার পর টাকা লুট, সমকামীতার নাটক সাজিয়ে চিরকুট
সাভারের ভাটপাড়ায় গোলাম কিবরিয়া নামের এক শিক্ষককে হত্যার পর চিরকুট লিখে রাখার ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। 
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, সোমবার (২১ আগস্ট) রাতে র‌্যাব-৪, ৬ ও ১৩ এর যৌথ অভিযানে যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর এলাকা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী মো. ইমন খান (২৩), মো. সাগর (২২) ও মো. ছাদেক গাজীকে (২২) গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে লুট করা ৫ লাখ ২১ হাজার ৯৯ টাকা উদ্ধার করা হয়।
র‍্যাবর মুখপাত্র জানান, নিহত শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া জমি কেনা-বেচা করতেন। এ কারণে তার কাছে সব সময় মোটা অংকের টাকা থাকতো। টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষককে হত্যার পর সমকামীতার চিরকুট লিখে নাটক সাজানো হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২০ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কক্ষ থেকে হাত-পা বাঁধা এবং গলায় গামছা পেঁছানো অবস্থায় গোলাম কিবরিয়া (৪৩) নামে সাবেক এক স্কুল শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় মরদেহের পাশ থেকে ‘এই ব্যক্তি সমকামীতা করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি, ভাই ও অবৈধ কাজ করে……..আমরা ইসলামের সৈনিক’ লেখা একটি চিরকুট পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদী হয়ে সাভার থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ৬২/৬৬৯।
স্থানীয়সূত্রের বরাত দিয়ে র‍্যাব বলছে, নিহত গোলাম কিবরিয়া সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিনি কয়েক বছর ধরে নিজ বাড়িতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। পাশাপাশি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন। গত ১৯ আগস্ট রাত ১০টার দিকে তার বড় ভাই মো. গোলাম মোস্তফার ঘরে রাতের খাবার শেষে নিজ কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘটনার দিন ২০ আগস্ট বেলা ২টার দিকে কিবরিয়া ঘুম থেকে না উঠায় তার বাড়ির লোকজন তাকে ডাকাডাকি করে। বাড়ির লোকজন ঘরের ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে তার ঘরের পেছনের দরজা খোলা দেখতে পায়।
এ সময় বাড়ির লোকজন রুমের ভেতর গিয়ে খাটের উপর লুঙ্গি দিয়ে নিহত শিক্ষকের হাত-পা বাঁধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় নিথর মৃতদেহ দেখতে পায়। এছাড়াও নিহতের রুমের মালামাল এলোমেলো এবং আলমারী খোলা অবস্থায় ছিল।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমকি জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, ইমনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। সাগর একজন অটোরিকশাচালক। তার রিকশায় নিহত শিক্ষক মাঝে মধ্যে যাতায়াত করার কারণে ২ বছর আগে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে গত ৬ মাস আগে সাগর তার বন্ধু ইমনকে শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয়ের সুবাধে ইমন ও সাগর শিক্ষক কিবরিয়ার বাসায় মাঝে মধ্যে যাওয়া আসা করতো।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, শিক্ষক গোলাম কিবরিয়া জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন এবং ব্যবসার যাবতীয় টাকা বাসায় রাখতেন। সাগর ও ইমন শিক্ষকের বাসায় যাওয়া আসার সুবাধে এই টাকা তাদের নজরে আসে। পরবর্তীতে তারা শিক্ষককে হত্যা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। ইমন তার পরিকল্পনার বিষয়টি ঘটনার ৭-৮ দিন আগে ছাদেককে বলে। ছাদেকের বিভিন্ন জায়গায় ঋণ থাকায় সে এই পরিকল্পনায় সম্মতি দেয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯ আগস্ট ইমন ও ছাদেক জিরানী বাজার থেকে বাসে করে সাভারের বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় এসে শিক্ষককে ফোন করে দেখা করতে চায়। শিক্ষক কিবরিয়া তাদেরকে বাসায় আসতে বলেন। আনুমানিক রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ইমন ও ছাদেক শিক্ষকের বাসায় আসেন। এ সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর অটোরিকশা নিয়ে শিক্ষকের বাসার আশেপাশে অবস্থান করেন। শিক্ষকের বাসায় তারা রাতের হালকা নাস্তা শেষে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে ছাদেক শিক্ষক গোলাম কিবরিয়ার গলা চেপে ধরে এবং ইমন তার মুখ চেপে ধরে।
পরবর্তীতে তারা কৌশলে শিক্ষক গোলাম কিবরিয়ার লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে গোলাম কিবরিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ছাদেক নিজ হাতে একটি সাদা কাগজে চিরকুট লিখে মৃত দেহের পাশে রেখে দেয়। ইমন নিহতের বিছানার নিচ থেকে চাবি নিয়ে আলমারী খুলে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৪টি মোবাইল নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে তারা সাগরের অটোরিকশায় করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে সাভার বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় চলে আসে।
কমান্ডার মঈন আরো বলেন, ইমন সাগরকে ৫০ হাজার টাকা দেয়। বাকি ৬ লাখ টাকা ইমন ও ছাদেক নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নেয়। ঘটনার পর দিন সকালে গ্রেফতার এড়াতে ইমন প্রথমে গাজীপুর পরে যশোরের চৌগাছা এলাকায়, সাগর রংপুরের মিঠাপুকুর, ছাদেক ঝিনাইদহে তাদের আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে র‍্যাব।
তিনি বলেন, ইমন মা-বাবাসহ প্রায় ১৫ বছর ধরে জিরানী এলাকায় বসবাস করছে। সে রাজধানীর আশুলিয়ার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে একটি গার্মেন্টসে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করত। মাদকাসক্ত ইমনের বিরুদ্ধে কাশিমপুর থানায় একটি ডাকাতি মামলা রয়েছে।
র‍্যাবের মুখপাত্র আরো বলেন, সাগর মা-বাবাসহ প্রায় ২০ বছর ধরে একই এলাকায় বসবাস করছিল। পেশায় অটোরিকশা চালক। সাগর ও তার পরিবারকে ২০১৯ সালে জিরানী এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ছাদেক মা-বাবাসহ প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকার জিরানী এলাকায় বসবাস করছে। একই এলাকায় গামেন্টসে চাকরি করতো।
administrator

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *